বাণিজ্য সময় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট: সংবিধান ও বাস্তবতা
২৪-০১-২০২১, ১১:২৫
ঈশিতা ব্রহ্ম

বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম ভাগে, আইনসভা অধ্যায়ে, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, ‘আইন প্রণয়ন ও অর্থসংক্রান্ত পদ্ধতি’ অনুযায়ী ৮১ অনুচ্ছেদে ’অর্থবিল’ ই ব্যবহারিক অর্থে বাজেট। সংবিধানের কোথাও বাজেট শব্দের নাম-নিশানা নেই অথচ লোকসমাজে বাজেট একটি বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত শব্দ।
সংসদে সম্পূরক এবং নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশের সময় ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে যে ‘বাজেট বক্তৃতা’ দেওয়া হয়, তা আইনত বাজেট নয়, সেটি অর্থবিলের নির্বাহী সারাংশ, এটিকে বড়জোর সরকারের ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির বার্ষিক বিবৃতি’ বলা যায়। ‘অর্থবিল’ আড়ালেই থেকে যায়, নথিতে তার অবস্থান ‘সংযোজনী’ হিসেবে।
বাজেট প্রস্তাব পেশের পর ‘বাজেট আলোচনা’য় অর্থবিলের পর্যালোচনা প্রাসঙ্গিকতা খুব একটা দেখা যায় না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট সংসদে পেশ ও পাসের পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধতাগুলো সংস্কারের দাবি জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ। এক ওয়েবিনারে আসছে বাজেটের সঙ্গে সংবিধানের সংগতি নিয়ে বেশকিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরে সংগঠনটি।
বাজেট কার, কার জন্য বাজেট
সংবিধানের ‘প্রস্তাবনায়’ সর্বপ্রথমে উচ্চারিত তিন শব্দ ’আমরা বাংলাদেশের জনগণ’; জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হওয়া উচিত সেই জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির, এই বাজেট বিশাল টাওয়ার কিংবা বড় গ্রুপ কোম্পানির কর্ণধারের যেমন এই বাজেট নীলফামারীর ডোমার উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র কৃষকের, শরৎচন্দ্রের গফুর ও মহেশের, চাষাদের, কামার, কুমার মজুরের, এই বাজেট রাষ্ট্রের, শুধু সরকারের নয়, শুধু পক্ষের নয় বিপক্ষেরও, সবার।
করোনা সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার মতো খাতগুলোকে অগ্রাধিকার পাবে। করোনার প্রভাবে বাজেট প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের গুরুত্ব আলোচিত হলেও, সেখানে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষা, দক্ষ জনসম্পদ তৈরিতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
উন্নয়নশীল অর্থনীতির বাজেট
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নিম্ন থেকে নিম্ন মধ্যবিত্তের তকমা পেতে হলে সব খাত ও ক্ষেত্রে একযোগে উন্নয়নশীল হতে হবে। কৃষি খাতে ভর্তুকি/প্রণোদনা যেন যথাযথভাবে এবং সঠিক সময়ে প্রান্তিক চাষিরা, খামারিরা পান সেটি নিশ্চিত করতে হবে। নতুন নতুন উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের অবদান কম নয়। সে জন্য সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত।
বাংলাদেশের প্রায় সব খাতে বীমার ব্যবস্থা থাকলেও গত বাজেটে কৃষি ও কৃষকের বীমার প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা, খামারি, মাছ চাষির কাছে প্রণোদনার টাকা পৌঁছায়নি। ব্যাংক বা আর্থিক খাতে কঠিন রোগের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি।
ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগবান্ধব বাজেট
বাজেটে একদিকে দুর্নীতির বিরূদ্ধে কঠোর অবস্থানের ও সুশাসনের কথা থাকলেও যেভাবে অপ্রদর্শিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে, তা দুঃখজনক। মাত্র ১০ শতাংশ হারে কর দিলে কোনো সংস্থা কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না, এভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলে নিয়মিত করদাতাদের আরও নিরুৎসাহিত করা হবে। এ জন্য যথাযথ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে কালো টাকা উপার্জনের পথ বন্ধ করা এবং উদ্ধারে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার আহ্বান বক্তাদের।
কর্মসংস্থানের জন্য ‘বাজেট বক্তৃতায়’ অনেক কথা বলা হয়। তবে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের হতাশা দূর, এই মুহূর্তে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন কাজের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটা কীভাবে সমন্বয় হবে, প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করা যাবে, সেই সুযোগের ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ ও দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।